একদিকে বিল খুকশিয়ার টিআরএম বন্ধ, অন্যদিকে বিল কপালিয়ার টিআরএম বাস্তবায়ন জটিলতায় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দুঃখখ্যাত ভবদহ সমস্যার সমাধান হলো না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, যশোরের মণিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর ও খুলনার ডুমুরিয়া এবং ফুলতলার সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ভবদহ বিল। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গেল শতাব্দীর ষাটের দশকে কোস্টাল ইমব্যাংকমেন্ট প্রজেক্টের (সিইপি) আওতায় ভবদহে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ইপি-ওয়াপদা) ভবদহের কুলিশাকূল এলাকায় ২২ ভেন্টের ¯øুইস গেট নির্মাণ করে, যা ‘ভবদহ সুইস গেট’ নামে পরিচিত।উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ ও সুইইস গেট নির্মাণের ফলে দুই দশক তীরবর্তী এলাকায় ভালো ফসল উৎপাদন হতো।
আশির দশকের দিকে ওই অঞ্চলের নদ-নদী দিয়ে বয়ে যাওয়া পলি নদী-খাল-নালা বেয়ে কৃষিজমিতে যেতে না পেরে নদীর তলদেশে জমা হতে থাকে। একপর্যায়ে বাঁধের বাইরের নদীর অংশ জমির চেয়ে উঁচু হয়ে যায়। কৃষিজমি পরিণত হয় জলাধারে।দেখা দেয় দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা। ১৯৯০ সালের দিকে স্থানীয় স্কুল-কলেজের ছাত্র-জনতা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নদী-খাল-বিলের জমাকৃত পলি ঘুলিয়ে(ঘুলাইয়া) নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে জোয়ার-ভাটা চালু করে।
১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা নিরসনে পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে কেজিডিআরপি (খুলনা-যশোর ড্রেনেজ রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট) বাস্তবায়ন করা হয়, যা ১৯৯৭ সালে সমাপ্ত হয়। কিন্তু এ প্রকল্পের কারণে বিল ডাকাতিয়া এলাকায় জলাবদ্ধতা কিছুটা কমে গেলেও ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা বা বন্যা মোকাবিলা ব্যর্থ হয়।অর্থাৎ ওই সময় জলাবদ্ধতা তীব্র ও জটিল আকার ধারণ করে। ১৯৯৭ সালে ভবদহ অঞ্চলে তথা হরি ও মুক্তেশ্বরী অববাহিকায় জলাবদ্ধতা ভয়ংকর রূপ নেয়।
বাঁচার তাগিদে ভুক্তভোগী মানুষ একটি ‘পানি কমিটি’ গঠন করে। কমিটির নেতৃত্বে ভায়না বিলের বাঁধ কেটে জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থা করা হয়। এদিকে পুনর্বাসন প্রকল্পের কেজিডিআরপি মোকাবিলা করতে পারেনি ২০০০, ২০০২ ও ২০০৪ সালের বন্যা। বন্যার পানি নির্দিষ্ট সময়ে সরে যাওয়ার কথা থাকলেও নিষ্কাশনব্যবস্থার ত্রæটির কারণে পানি আটকে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ২০০৬ সালের জলাবদ্ধতা অনেক বেশি যন্ত্রণা ও দুর্ভোগের কারণ হয়। ২০০৮, ২০০৯ ,২০১১,২০১৫,২০১৮ সালে জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে যশোরের মণিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, সদর উপজেলার একাংশ, খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা, সাতক্ষীরার তালা, কলারোয়া ও সদরের বিস্তীর্ণ জনপদ।
এদিকে ২০০৬ সালের ২৭ এপ্রিল বিল খুকশিয়ার টিআরএম চালু হলেও নানা প্রতিকূলতার কারণে ছয় বছর পর ২০১২ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। বিল খুকশিয়ার পর ২০১২ সালের জুন মাসের ২ তারিখে বিল কপালিয়ায় টিআরএম উদ্বোধন করতে গেলে বিল কপালিয়াবাসীর সঙ্গে পাউবোর কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সহিংস ঘটনা ঘটে। এরপর প্রকল্পটি এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। স্থগিতাদেশের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর প্রকল্পটি পুনরায় শুরুর জন্য পরিকল্পনা কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল বিল কপালিয়া এলাকা পরিদর্শন করেন। টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের সহজ শর্তে ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে স্থানীয় নেহালপুর ইউপির চেয়ারম্যানকে সভাপতি ও পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলীকে সদস্যসচিব করে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।এরপর তার আর কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,বহু গবেষণা-বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ করে ভবদহ জলাবদ্ধতা সমস্যার অন্যতম সমাধান হিসেবে ‘জোয়ারধার’ পদ্ধতিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। মূলত নদীসংলগ্ন বিলে বাঁধ তৈরি করে নদীর পাড় কেটে দিয়ে জোয়ারের সঙ্গে নদী দিয়ে আসা পলি বিলে জমা হতে দেওয়া হয়। এতে করে নদীর নাব্য অটুট থাকে। বিলে বাঁধ দিয়ে ‘টিআরএমের’ মাধ্যমে পলি ব্যবস্থাপনার এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘জোয়ারধার’। পলি ব্যবস্থাপনার এই ‘জোয়ারধার’ পদ্ধতি কার্যকর না থাকায় বর্ষা মৌসুমে ভবদহ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখের অন্ত থাকে না। শত শত গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান নষ্ট হয়ে যায়। পানিবন্দি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়।বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
ফলে ভবদহ অঞ্চলের সার্বিক জীবন ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাবসহ অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। ভবদহে ‘টিআরএম’ আবার বাস্তবায়ন করা গেলে জলাবদ্ধতা যেমন দূর হবে; তেমনি নদ-নদীও সচল থাকবে।
ভবদহ পাড়ের হাটগাছা গ্রামের বাসিন্দা মুকুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন,ইতিমধ্যে আমাদের এলাকায় পানি ওঠে গেছে। আর একটু বৃষ্টি হলেই পানি বন্দী হয়ে পড়বে ভবদহ পাড়ের অন্ততঃ ৩০-৪০টি গ্রামের মানুষ।
ভুক্তভোগী রুহুল আমিন বলেন, ‘নদীগুলোর অবস্থা দেখে আমরা রীতিমতো স্তম্ভিত। জোয়ারে নদী দিয়ে পানি আসছে ঠিকই কিন্তু ভাটায় পানি নামছে খুব সামান্য। পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় বৃষ্টির পানিতে বিলগুলো ভরে উঠছে। টিআরএম নিয়ে এলাকার মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। একটি মহল টিআরএম নিয়ে সরকারকে বিভ্রান্ত করছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে অবিলম্বে বিল কপালিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়ন করতে হবে।
ভবদহ পানি ষ্কিাশন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহবায়ক গাজী হামিদ বলেন ,নদীগুলো পলিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জোয়ারের পানি আসছে নদীগুলোতে। কিন্তু ভাটায় পানি নামছে কম। নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় এলাকার বিলগুলো বৃষ্টির পানিতে ভরে উঠছে। কয়েকদিন টানা বৃষ্টিতে পরিমাণ বাড়লে বিল সংলগ্ন উপচে সংলগ্ন গ্রামগুলোতে পানি ঢুকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আগামীতে বৃষ্টি লেগে থাকলে কয়েক লাখ মানুষ জলাবদ্ধতায় পানি বন্দী হয়ে পড়বে।
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যান্যার্জী বলেন, ‘ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে।আমি ভবদহ এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেছি।পানি যাতে বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সে জন্য খুব শীঘ্রই খনন কাজ শুরু হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী পলাশ বলেন,জলাবদ্ধতা নিরসনে টিআরএমই একমাত্র উপায়,এমনটি নয়,এর পক্ষ-বিপক্ষ দুটিই আছে।তাছাড়া এটি একটি বড় বিষয়,যার সিদ্ধান্ত উপর থেকেই হবে।