দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও জাতিগত স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাত প্রকট আকার ধারণ করেছে। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের আক্রমণে একের পর এক ঘাঁটি হারিয়ে কোণঠাসা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা; পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে বহু জান্তা সৈনিক। এ অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যদের আবারও যুদ্ধের ময়দানে ফেরত পাঠাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতী। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় এবার রিজার্ভ ফোর্সেস আইন সক্রিয় করেছে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার। আর এর মাধ্যমে অবসরে চলে যাওয়া প্রবীণ সেনা সদস্যদের আবারও যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে ফেরত পাঠানোর ক্ষমতা পেয়েছেন জেনারেল মিন অং হ্লাইং।
আরো পড়ুন:তিন দিন ধরে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় মিয়ানমারের জাহাজ
জান্তা প্রধান গত মঙ্গলবার বলেছেন, প্রবীণ সেনাদের ইচ্ছাতেই তিনি এই পদক্ষেপ নিচ্ছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে ওইদিন বৈঠকে তিনি আরও বলেন, অবসরপ্রাপ্ত সৈন্যরা জাতীয় প্রতিরক্ষার স্বার্থে আবারও দায়িত্বে ফিরতে চান। জেনারেল মিন অং হ্লাইং মিয়ানমার ওয়ার ভেটেরান্স অর্গানাইজেশনেরও সভাপতি। মঙ্গলবারের সেই বৈঠকের পর একইদিন রাতে তিনি আইনটিতে স্বাক্ষর করেন। মূলত ‘রিজার্ভ ফোর্সেস ল’ আইনটি ২০১০ সালে তৎকালীন স্বৈরশাসক থান শোয়ের নেতৃত্বাধীন জান্তা সরকার জারি করেছিল, কিন্তু কখনও ব্যবহার করা হয়নি। এবারই প্রথম আইনটি সক্রিয় করা হলো। মিয়ানমার ওয়ার ভেটেরান্স অর্গানাইজেশনের ওয়েবসাইট অনুসারে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মিয়ানমারের এই সংগঠনটির দেশব্যাপী ৯১ হাজার ৬৭৭ সদস্য এবং ১ লাখ ৬১ হাজার ৩৭২ জন সহায়ক সদস্য ছিলেন। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির ৩৩০টি শহরের মধ্যে ৩০৮টিতে এই সংগঠনের শাখা রয়েছে। জেনারেল মিন অং হ্লাইং বলেন, অবসরে যাওয়া সমস্ত প্রবীণ সৈনিককে সক্রিয় দায়িত্বে ফিরিয়ে নেওয়া হবে না। যারা যোগ্য এবং উপযুক্ত তাদেরই যুদ্ধের ময়দানে ফেরত পাঠানো হবে।
আরো পড়ুন:মিয়ানমারের সেনাদের সমুদ্রপথে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে
এর ব্যাখ্যায় জান্তার মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন তুনকে উদ্ধৃত করে জান্তা মিডিয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা গত পাঁচ বছরে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণের অনুমতি পেয়েছে তারা রিজার্ভ ফোর্সে কাজ করার জন্য বাধ্য। তবে, তাদের সবাইকে সক্রিয় দায়িত্বে ফিরিয়ে নেওয়া হবে না। যাদের সত্যিকার অর্থে দেশের জন্য প্রয়োজন তাদেরকেই ‘সেবা করার’ অনুমতি দেওয়া হবে।’ এই আইনের অধীনে সাবেক সব সামরিক কর্মীকে পাঁচ বছরের জন্য রিজার্ভ বাহিনীতে কাজ করতে হবে। তবে সামরিক বাহিনীর প্রধান ‘রাষ্ট্রের স্বার্থে’ পাঁচ বছরেরও বেশি সময় তাদের চাকরিতে বাধ্য করতে পারবেন। আইনে অবশ্য তাদের সেবার মেয়াদ কতদিন বাড়ানো যাবে তা বলা হয়নি। শুধু তাই নয়, রিজার্ভ ফোর্সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তিন বছরের জেল বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন সাবেক সেনা সদস্যরা। ইরাবতী বলছে, যাদের ফ্রন্টলাইনে ফেরত পাঠানো হবে তারা তাদের পেনশনের পাশাপাশি সামরিক প্রধান কর্তৃক প্রদত্ত অন্যান্য সুবিধা পাবেন। অবসর গ্রহণ বা পদত্যাগ করার সময় যারা যে পদে ছিলেন তাদের একই পদে নিয়োগ দেওয়া হবে বলেও আইনে বলা হয়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেসামরিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং অভ্যুত্থানবিরোধী যোদ্ধাদের সঙ্গে একের পর এক যুদ্ধে তাদেরকে পরাজিত হতে দেখা যাচ্ছে। এর আগে মিয়ানমারে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করে দেশটির জান্তা সরকার।
আরো পড়ুন:ফের ৬৩ মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশে প্রবেশ
নতুন সেই ঘোষণা অনুযায়ী, এখন থেকে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সব পুরুষকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে অন্তত দুই বছর কাজ করতে হবে। আর নারীদের মধ্যে যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৭ বছরেরে মধ্যে, তাদেরকেও একই মেয়াদে সামরিক বাহিনীতে চাকরি করতে হবে। এ বিষয়ে আর কোনও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি জান্তা সরকার। মূলত সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে জাতগত স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোর কাছে একের পর এক শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল জান্তা সরকার। সম্প্রতি সেই জরুরি অবস্থা আরও ছয় মাসের জন্য বাড়ানো হয়েছে।উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জান্তা বাহিনীর ক্ষমতা পুনর্দখলের পর থেকেই মিয়ানমারে যুদ্ধ ও সহিংসতা চলে আসছে। এসব সহিংসতায় এ পর্যন্ত দেশটির হাজার হাজার নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন এবং দশ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।মূলত স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলমান থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ের মতো এতোটা চ্যালেঞ্জের মুখে আর কখনও পড়েনি দেশটির জান্তা বা সামরিক শাসকরা।
One thought on “এবার বুড়ো ঘোড়াদের যুদ্ধে পাঠাচ্ছে মিয়ানমার জান্তা!”